খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) - সাইফুল্লাহ । অপরাজিত মুসলিম বীর

অপরাজিত মুসলিম বীর, খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) এর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে প্রথম পর্বে আমরা অনেক কিছু জেনেছি; আজ দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে হাজির হলাম।

আল্লাহর তরবারি ('সাইফুল্লাহ') বলা হয় কাকে?

বিশ্ববিখ্যাত অপরাজিত মুসলিম বীর খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) যার উপাধি ছিল সাইফুল্লাহ বা, আল্লাহর তরবারী ।আল্লাহ্‌র রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁকে ‘সাইফুল্লাহ’ উপাধি দিয়েছিলেন।

খালিদবিনওয়ালিদ-সাইফুল্লাহ-অপরাজিত-মুসলিম-বীর-bangla-tech-info

কোন সাহাবীকে 'সাইফুল্লাহ' বলা হয়?

অপরাজিত মুসলিম বীর হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) কে সাইফুল্লাহ বা আল্লাহর তরবারি বলা হতো। খালিদ বিন ওয়ালিদ মূতার যুদ্ধে সাইফুল্লাহ উপাধী লাভ করেছিলেন। তিনি মূতার যুদ্ধে নয়টি তরবারী ভেঙ্গেছিলেন।

আজীবন অপরাজিত ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি

যিনি রণক্ষেত্রে নিজের শক্তি ও মেধার দ্বারা ইসলামের ঝান্ডাকে বুলন্দ করেছিলেন। মিসরের খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক আববাস মাহমুদ আল-আক্কাদ ‘আবকারিয়াতু খালিদ’ নামক গ্রন্থে তাঁর সামরিক ব্যক্তিত্বের পর্যালোচনা করে বলেন, ‘সামরিক নেতৃত্বের সব গুণাবলীই খালিদ (রাঃ)-এর মধ্যে ছিল। বাহাদুরী, সাহসিকতা, উপস্থিত বুদ্ধি, তীক্ষ্ম মেধাসম্পন্ন, অত্যধিক ক্ষিপ্রতা এবং শত্রুর উপর অকল্পনীয় আঘাত হানার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়।

হযরত-খালিদ-বিন-(রাঃ)-এর-পোশাক

হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-এর বিষপান এর ঘটনা

একবার দামেস্ক এর একটি দুর্গ ঘেরাও করেছিলেন ছিলেন তিনি। দুর্গবাসী'রা অবরোধে এর জীবন সহ্য করতে না পেরে তাদের ইচ্ছা হলো সন্ধি করার। যেইনা দুর্গপতিকে আপোষের প্রস্তাব দিয়ে হযরত খালিদ বিন ওলীদ (রা.)-এর নিকট পাঠানো হলো।

প্রতিপক্ষের সর্দার সন্ধিবার্তা নিয়ে বীরশ্রেষ্ঠ খালিদ (রা.)-এর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি দুর্গপতি'র হাতে একটি ছোট বোতল দেখে জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমার হাতে এটি কিসের বোতন? এর মধ্যে কি আছে? এটি কেন নিয়ে এসেছো?'

দুর্গপতি উত্তর দিলো; 'এ বোতলে রয়েছে বিষ! এই ভেবে নিয়ে এসেছি যে, 'যদি আপনার সাথে সন্ধির আলোচনায় সফল হই, তবে ফিরে যাবো আর যদি ব্যর্থ হই; সন্ধি করতে না পারলে পরাজিত মুখ নিয়ে দুর্গে ফিরে যাবো না; বরং এই বিষ পান করে আত্মহত্যা করার শপথ নিয়েই এসেছি এখানে।'

সাহাবীগণের জীবনের প্রকৃত ও প্রধান উদ্দেশ্য ই হলো 'দীন ইসলামের দাওয়াত'। তিনি দুর্গপতি কে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমার কি এই বিষের উপর এমনই বিশ্বাস আছে যে, পান করার সাথে সাথেই তুমি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে? সর্দার উত্তর দিল, হ্যাঁ! এটা পানে মৃত্যু অবধারিত।

এর বিষক্রিয়া এমন ভীষণ মারাত্মক যে, আজ পর্যন্ত কেউ এই বিষের স্বাদ গ্রহন করে বলার সুযোগ পায়নি। কারণ, মুখে নেয়ার সাথে সাথেই তার মৃত্যু হয়ে গেছে। এ জন্যই আমার দৃঢ বিশ্বাস, এটা ব্যবহারের সাথে সাথেই নিঃসন্দেহে আমি মারা যাবো।

বীর মুজাহিদ হযরত খালিদ (রা.) দুর্গপতিকে বললেন, যে বিষের উপর তোমার এতটাই ভরসা সেই বোতল টা আমাকে একটু দাও দেখি। দুর্গপতি বিষের বোতল টি তাঁর হাতে দিয়ে দিলো। হযরত খালিদ (রা.) বিষের শিশি হাতে নিয়ে বললেন, এ সৃষ্টি জগতের কোন কিছুর ই নিজস্ব কোন শক্তি ও প্রভাব নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হুকুম না করেন, আমি আল্লাহ পাকের নাম নিয়ে এবং এই দু’আটি পড়ে

بسم الله الذي لايضر مع اسمه شيئ في الأرض ولا في السماء وهو السميع العليم

‘আল্লাহর নামে যার নামে কোন কিছু ক্ষতি করতে পারে না। আসমানে ও যমীনে, তিনি সর্বশ্রোতা সব কিছু জানেন,

এই বিষ পান করছি। এখন দেখা যাক আমি মারা যাই নাকি বেঁচে থাকি। সর্দার বলে উঠল জনাব! আপনি নিজের উপর জুলুম করবেন না। এ বিষ এমন সাংঘাতিক ও মারাত্মক যে, কিছুটা মুখে লাগলেও সাথে সাথে মারা যাবে য কেউ। আর আপনি পূর্ণ বোতল পান করার ইচ্ছা করছেন। দৃঢ়ভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করে হযরত খালিদ (রা.) বললেন, আমার কিছু হবে না 'ইনশাআল্লাহ'। দুআ পড়ে বোতলের সবটুকু বিষ মুখে ঢেলে গিলে ফেললেন। আল্লাহ পাকের স্বীয় কুদরতী কারিশমা দেখা গেল।

কাফের সম্প্রদায়ের নেতা দুর্গপতি নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছে না যে, মুসলিম সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা:) পূর্ণ বোতলের সবটুকু বিষ পান করার পরেও মারা যাবার কোন আলামত প্রকাশ পাচ্ছিলো না।

এ অবস্থা দেখে অবশেষে দুর্গপতি মুসলমান হয়ে নিজের জীবন কে ধন্য করেন; আশ্রয় গ্রহণ করেন ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে।

মাওলানা তাকি উসমানী এর 'হৃদয় ছোঁয়া গল্প' বই থেকে লিখাটি সংগৃহীত।

মরণের আগে আক্ষেপঃ

মৃত্যু শয্যায় মহাবীর খালিদ প্রিয়তমা স্ত্রীকে বললেনঃ

‘প্রিয়তমা স্ত্রী, আমি বেশিক্ষণ বাঁচবো বলে মনে হচ্ছে না। একটা আফসোস এই বিদায় বেলায় ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে, তুমি কি উত্তর দিতে পারো?

স্ত্রী বিনয়ের সাথে জিজ্ঞাসা করলেনঃ

হে মহাবীর, কি প্রশ্ন আপনার মনে?
খালিদ-বিন-ওয়ালিদ-এর-কবর-grave-of-khalid-bin-waleed

৫৭ বছরের খালিদ বললেন:

তুমি আমার সারাটা শরীর পরীক্ষা করে দেখো, এমন কোনো স্থান কি আমার শরীরে আছে যেখানে শত্রুর তরবারীর আঘাত নেই?

দীর্ঘক্ষণ পরীক্ষা করে স্ত্রী উত্তর দিলেন:

না, আল্লাহর রাস্তায় আপনি এতো বেশি যুদ্ধ করেছেন যে শত্রুর আঘাত আপনার সারাটা শরীরেই আছে।

খালিদ বিন ওয়ালিদ তখন দুঃখ নিয়ে বললেন:

আল্লাহর কসম! প্রতিটা জিহাদে আমার নিয়ত থাকতো যেনো আমি ময়দানে শত্রুর আঘাতে মারা যাই, তাতে যেনো শহিদের মর্যাদা পাই। কিন্তু আফসোস! দেখো আজ যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যু না হয়ে আমার মৃত্যু হচ্ছে আমারই বিছানায়! আমায় কি আল্লাহ শহিদদের মাঝে রাখতে চান না?

স্বামীর আফসোস দেখে স্ত্রী কিছুক্ষণ মৌন রইলেন। এরপর করলেন সেই বিখ্যাত উক্তি:

আপনার নাম স্বয়ং রাসূল (সা.) রেখেছিলেন ‘সাইফুল্লাহ’ এমন কোনো তরবারী কি দুনিয়ায় আছে যেটা আল্লাহর তরবারীর মোকাবিলা করতে পারে? তাই তো ময়দানে আপনার মৃত্যু হয়নি কারণ আল্লাহ তাঁর তরবারী মাটিতে লুটিয়ে যেতে দেননি।

ভীষণ খুশি হলেন খালিদ বিন ওয়ালিদ, বুঝতে পারলেন আল্লাহর ইচ্ছা এবং কিছুক্ষণ পরে শান্তিতে বেহেস্তের রাস্তায় চলে গেলেন। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা খালিদ বিন ওয়ালিদ এর মৃত্যুর পর বলেছিলেন,

আজ দুনিয়ার সকল নারীরা খালিদ এদের মত সন্তান প্রসবে ব্যর্থ হয়ে গেছে।

আসুন, মহাবীর খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) - সাইফুল্লাহ অপরাজিত মুসলিম বীর এর জীবনী নিয়ে একটি ইউটিউব ভিডিও দেখে আসি।

খালিদ বিন ওয়ালিদ এর জীবনী থেকে আমাদের উপলদ্ধি

আজকের দিনে অনেকেই আমরা সম্রাট জুলিয়াস সিজার এর গুনগান করি, আলেকজান্ডার এর ঘটনা মন দিয়ে শুনি, নেপোলিয়ান কে শ্রেষ্ঠত্ব বলি। অথচ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে গবেষণা করলে সবাই একবাক্যে স্বীকার করবে যে সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ এর নেতৃত্বগুণ, বীরত্ব আর রণকৌশলের সামনে অন্য যেকোনো সেনানায়কই তুচ্ছ। এক কথায় খালিদ বিন ওয়ালিদ ই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। আর এসব কোনো কল্পকাহিনী নয়, ইতিহাস ঘাটলেই তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানিত হয়। এমন বীর সাহাবী'দের জীবনী যেনো আমাদের প্রতিদিনের পথচলায় অনুপ্রেরণার উৎস হয়......।

আল্লাহর কাছে আমাদের আকুল প্রার্থনাঃ

হে আল্লাহ; তুমি মুসলমানের এই দুর্দিনে অপরাজিত মুসলিম বীর খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) কে পৃথিবীতে আবার পাঠাও; আবারো ইসলামের কালেমা'র পতাকা পতপত করে উড়তে থাকুক।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post